কপালকুণ্ডলা উপন্যাসের কপালকুণ্ডলা চরিত্র বিশ্লেষণ – সাগরতীর বাসিনী কাপালিক কর্তৃক প্রতিপালিত চির সন্ন্যাসিনী কপালকুণ্ডলা এ উপন্যাসের কেন্দ্রীয় চরিত্র।
কপালকুণ্ডলা উপন্যাসের কপালকুণ্ডলা চরিত্র বিশ্লেষণ – বাংলা সাহিত্যের সার্থক উপন্যাসের স্রষ্টা বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় (জন্ম : ১৮৩৮; মৃত্যু : ১৮৯৪) বিদ্যাসাগরের পরেই যার আবির্ভাব। নানা কারণেই বঙ্কিমচন্দ্র একজন সার্থক ঔপন্যাসিক। তাঁর উপন্যাসের কাহিনী বিন্যাস শিল্পরীতি চরিত্রায়ন কৌশল ইত্যাদি বৈশিষ্ট্যাবলী অপরাপর ঔপন্যাসিকদের থেকে তাকে আলাদা করেছে।
ডক্টর শ্রীকুমার বন্দোপাধ্যায় যথার্থই বলেছেন , “বঙ্কিমের হাতে বাংলা উপন্যাস পূর্ণ যৌবনে শক্তি ও সৌন্দর্য লাভ করেছে।”
কপালকুণ্ডলা (১৮৬৬) বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে প্রথম রোমান্টিক উপন্যাস। শিল্পকলার বিচারে এটি একটি সামান্য রচনা হলেও বঙ্কিমের স্পর্শে উপন্যাসটি চূড়ান্ত পর্যায়ে উপনীত হয়েছে। সাগরতীর বাসিনী কাপালিক কর্তৃক প্রতিপালিত চির সন্ন্যাসিনী কপালকুণ্ডলা এ উপন্যাসের কেন্দ্রীয় চরিত্র। তাকে কেন্দ্র করেই উপন্যাসের সকল ঘটনা চরিত্র আবর্তিত হয়েছে এবং পরিণীতি লাভ করেছে।
কপালকুণ্ডলার সৌন্দর্যের বর্ণনা
কপালকুণ্ডলা উপন্যাসের কপালকুণ্ডলা চরিত্র বিশ্লেষণ – এ শুরুতেই আসি আমরা কপালকুণ্ডলার সৌন্দর্যের বিশ্লেষণে।রূপের মোহ বা রূপের বর্ণনা বঙ্কিমের উপন্যাসের একটি অতি আবশ্যকীয় উপাদান। ঔপন্যাসিক তার কপালকুণ্ডলা উপন্যাসের প্রধান চরিত্র কপালকুণ্ডলা কে সৃষ্টি করতে গিয়েও কপালকুণ্ডলার মধ্যে এই বিশেষ বৈশিষ্ট্য ফুটিয়ে তুলেছেন।
কপালকুণ্ডলা সৌন্দর্য প্রিয় নারী। তার সৌন্দর্য মুগ্ধতা ঔপন্যাসিক দুইভাবে তুলে ধরেছেন-
- কপালকুণ্ডলা কে আমরা প্রথম দেখতে পাই সমুদ্র তীরে। প্রকৃতির সৌন্দর্য মুগ্ধতা তার মধ্যে ছিল। তাই সে সমুদ্রের তীরে দাঁড়িয়ে সমুদ্রের নয়নাভিরাম সৌন্দর্য দেখছিল।
- নবকুমারকে দেখার আগে কপালকুণ্ডলা কাপালিকের আশ্রমে অনেক পুরুষকে দেখেছে। কিন্তু কাউকে সে বাঁচাতে আসেনি। নবকুমারের রূপ তার চিত্রে এমন এক ধরনের আকর্ষণ, এমন এক ধরনের সৌন্দর্য প্রীতি নিয়ে এসেছে, যা তাকে নিজের জীবনের ঝুঁকি নিয়েও নবকুমারকে বাঁচানোর অনুপ্রেরণা দিয়েছে। এখানে বঙ্কিম তার সৌন্দর্য প্রিয় ও মনুষ্য প্রীতি ফুটিয়ে তুলেছেন।
কপালকুণ্ডলা সমাজ-সংসার সম্পর্কে অনভিজ্ঞ
কপালকুণ্ডলা উপন্যাসের কপালকুণ্ডলা চরিত্র বিশ্লেষণ করলে দেখা যায় কপালকুণ্ডলা সমাজ-সংসার সম্পর্কে অনভিজ্ঞ এক রমণী। কারণ কপালকুণ্ডলা মানব সমাজের বাইরে কাপালিক কর্তৃক প্রতিপালিতা। তন্ত্রসাধনায় স্ত্রীর লোকের যে কি সম্পর্ক তা তিনি জানেন না। কপালকুণ্ডলা যখন নবকুমারকে কাপালিকের হাত থেকেরক্ষা করে অধিকারীর কাছে নিয়ে আসেন; তখন অধিকারী সে বিষয়ে (জগৎ সংসার ) কিছু আভাস দিয়েছেন।কিন্তু কপালকুণ্ডলা তা বুঝতে পারেনি।
কপালকুণ্ডলা বলেন, “বিবাহের নাম তো তোমাদিগের মুখে শুনিয়া থাকি ,কিন্তু কাহাকে বলে সবিশেষ জানিনে। কি করিতে হইবে ? “

তার ভিতর কোন হিংসা-বিদ্বেষ নেই। তাইতো সে লুৎফুন্নিসার কথায় তার স্বামীকে নিঃস্বার্থভাবে ত্যাগ করতে রাজি হয়।
এছাড়াও কপালকুণ্ডলার সংসার জ্ঞান ছিল না এটা আরো বোঝা যায় কপালকুণ্ডলা উপন্যাসের কপালকুণ্ডলা চরিত্র বিশ্লেষণ -র এই দিকটাতে। উপন্যাসের এই দিকটিতে আমরা দেখতে পাই মতি বিবির পোশাক পরিচ্ছদ দেখে কপালকুণ্ডলা বিস্মিত হয়েছেন। অলংকারের মূল্য ও গুরুত্ব কপালকুণ্ডলা বুঝে না। তাই তো মতি বিবি দেওয়া সকল গহনা তিনি ভিক্ষুককে দান করেছেন। সেই গহনা নিয়ে ভিক্ষুক ছুটে পালিয়েছে। ভিক্ষুকের এই আচরণে কপালকুণ্ডলা বিস্মিত হয়ে ভাবলেন,
“ভিক্ষুক দৌড়িল কেন?”
পরোপকারী ও সহানুভূতিশীল
কপালকুণ্ডলা চরিত্রে প্রধান বৈশিষ্ট্য তার পরোপকার করার মনোবাসনা। কপালকুণ্ডলা উপন্যাসের কপালকুণ্ডলা চরিত্র বিশ্লেষণ করলে দেখতে পাই ; তার এই মনোবাসনার পিছনে রয়েছে অন্তরের গভীর মমতা ও সহানুভূতিশীলতা।তাই বিরোধিতা করেছেন নরবলীর। ফলে তার জীবনে নেমে এসেছে ট্রাজেডির কালো মেঘ।
কপালকুণ্ডলার ঠাকুরঝি (ননদ) শ্যামা সুন্দরীর উপকার হবে ভেবে তিনি ঔষধ সংগ্রহের জন্য রাতে একাকী বনে গিয়েছেন। সেখানেই দেখা হয়েছে পদ্মাবতীর সাথে এবং তিনি জেনেছেন পদ্মাবতী তার সপত্নী (সতীন)। আর পদ্মাবতী খুঁজছেন স্বামী নবকুমারকে। সুতরাং সপত্নীর (সতীন) সুখের পথ তিনি রুদ্ধ করতে চাননি।কপালকুণ্ডলা পদ্মাবতীকে বললেন ,
“আমি তোমার সুখের পথ কেন রোধ করিব? তোমার মানসসিদ্ধ হউক – কালি হইতে বিঘ্নকারিনীর কোন সংবাদ পাইবে না। আমি বণচর ছিলাম, আবার বণচর হইব।”
ধর্মীয় সংস্কার ও দেবতার প্রতি বিশ্বাস
ধর্মীয় সংস্কার কপালকুণ্ডলার অন্যতম বৈশিষ্ট্য। দেবীর বরণে অর্পিত বিল্বপত্র পড়ে গেলে তিনি শঙ্কিত ও বিষন্ন হয়েছেন। কপালকুণ্ডলা বিশ্বাস করেছেন নবকুমারের সঙ্গে এই যাত্রা অশুভ। তিনি ভাগ্য বিশ্বাস করেন। তাই বলেন,
“যাহা তিনি করাইবেন তাহাই করিব যাহা কপালে আছে তাহাই ঘটিবে।”
দৃঢ়চেতা ও স্বাধীনচেতা
কপালকুণ্ডলা উপন্যাসের কপালকুণ্ডলা চরিত্র বিশ্লেষণ করতে গিয়ে দেখতে পাই সংসারে কপালকুণ্ডলা একজন দৃঢ় ও স্বাধীনচেতা মানুষ। স্বাধীনতার বাধা পেতেই তার মন বিদ্রোহ করে উঠেছে এবং বলেছে ,
“যদি জানিতাম যে স্ত্রীলোকের বিবাহ দাসীত্ব, তবে কদাপি বিবাহ করিতাম না।”
সংসারে কপালকুণ্ডলা নতুন নাম মৃন্ময়ী। নাম পরিবর্তন হলো কিন্তু মনের পরিবর্তন ঘটে না। শ্যামা সুন্দরী তাকে বলেছেন ‘তপস্বিনী’। তার জীবনে সংসার সম্পর্কে বিন্দুমাত্র আকর্ষণ নেই। স্বামী পুত্র সংসারে তার কোন সুখ নেই। কপালকুণ্ডলা বলেন,
“বোধ করি সমুদ্র তীরে সেই বনে বনে বেড়াইতে পারিলে আমার সুখ জন্মে।”
নিয়তির কন্যা কপালকুণ্ডলার পরিণতি
এ পর্যায়ে কপালকুণ্ডলা উপন্যাসের কপালকুণ্ডলা চরিত্র বিশ্লেষণ রোমান্সের আলোকে কপালকুণ্ডলা উপন্যাস করলে দেখা যায় কপালকুণ্ডলা নিয়তির সন্তান। শৈশবে বাবা-মা সমাজ থেকে বিচ্ছিন্নতা, জলদস্যু কর্তৃক অপহরণ ও পরিত্যাগ এবং অনন্ত গঙ্গা প্রবাহের মধ্যে হারিয়ে যাওয়া -এসবই নিয়তির খেলা।
কাপালিকের আশ্রমে বড় হয়ে ওঠায় তার মধ্যে এক ধরনের অধ্যাত্ম চেতনা কাজ করে। তাই নবকুমারের সাথে বিয়ের পর দেবীর পদে বিল্বপত্র দান এবং তা পরে যাওয়ার ফলে তার মনে প্রবল বিশ্বাস জন্মে এ বিয়ে সুখের হবে না। বস্তুত নিয়তির প্রতি প্রবল বিশ্বাস রেখেই সে তার জীবনের করুন পরিণতি দর্শন করেছে।
আবার চতুর্থ খন্ডের তৃতীয় পরিচ্ছদে সে স্বপ্ন দেখে এবং অষ্টম পরিচ্ছদে ভবানীর মূর্তি ও দৈববাণী এসবই কপালকুণ্ডলাকে অতি দ্রুত ট্রাজেডির দিকে নিয়ে গেছে। আসলে কপালকুণ্ডলা নিয়তির প্রভাব থেকে কখনো মুক্ত হয়নি এবং হতে চায়নি। কেননা সে নিয়তির কন্যা।

❓ সাধারণ কিছু প্রশ্নোত্তর (FAQ)
কপালকুণ্ডলা উপন্যাসের কপালকুণ্ডলা চরিত্র বিশ্লেষণ করে নিচে কপালকুণ্ডলা উপন্যাসের কিছু প্রশ্নোত্তর দেওয়া হয়েছে।
প্রশ্ন: বাংলা সাহিত্যের প্রথম রোমান্টিক উপন্যাস কোনটি?
উত্তর: বাংলা সাহিত্যের প্রথম রোমান্টিক উপন্যাস কপালকুণ্ডলা ।
প্রশ্ন: বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় কয়টি উপন্যাস লিখেছিলেন?
উত্তর: বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় মোট ১৪ টি উপন্যাস লিখেছিলেন।
প্রশ্ন: কপালকুণ্ডলা উপন্যাসটি কত সালে প্রকাশিত হয়?
উত্তর: কপালকুণ্ডলা উপন্যাসটি ১৮৬৬ সালে প্রকাশিত হয় ।
প্রশ্ন:কপালকুণ্ডলার স্বামীর নাম কি?
উত্তর: কপালকুণ্ডলার স্বামীর নাম নবকুমারে।
প্রশ্ন:কপালকুণ্ডলার ননদের নাম কি?
উত্তর: কপালকুণ্ডলার ননদের নাম শ্যামা সুন্দরী।
প্রশ্ন: নবকুমারের প্রথম স্ত্রীর নাম কি?
উত্তর: নবকুমারের প্রথম স্ত্রীর নাম পদ্মাবতীকে ।
প্রশ্ন:কপালকুণ্ডলা কার কাছে বড় হয়েছে?
উত্তর: কপালকুণ্ডলা কাপালিকের কাছে বড় হয়েছে।
প্রশ্ন:বিবাহের নাম তো তোমাদিগের মুখে শুনিয়া থাকি ,কিন্তু কাহাকে বলে সবিশেষ জানিনে। কি করিতে হইবে ? – উক্তিটি কার?
উত্তর: কপালকুণ্ডলার ।
আমার অভিব্যক্তি
বঙ্কিমচন্দ্রের অনবদ্য সৃষ্টি বাংলা সাহিত্যের প্রথম রোমান্টিক উপন্যাস কপালকুণ্ডলা। কপালকুণ্ডলা উপন্যাসের কপালকুণ্ডলা চরিত্র রহস্যময় ও বিচিত্র।সাগর তীরে কাপালিক পালিত প্রকৃতি প্রেমী কপালকুণ্ডলা। তার জগত সংসার সম্পর্কে কোন জ্ঞান নেই। তিনি প্রকৃতির মাঝেই প্রকৃত সুখ খুঁজে পায়।তিনি তিনি দেব-দেবী ও নিয়তিতে দৃঢ়বিশ্বাসী। তাই তার জীবনের শেষ পর্ব ট্রাজেডির মধ্য দিয়ে শেষ হয়। এক কথায়বলা যায়, কপালকুণ্ডলা উপন্যাসে কপালকুণ্ডলা চরিত্রটি প্রকৃতি ও রহস্যঘেরা রোমাঞ্চকর মানব চরিত্র।
উপসংহার
কবি চিত্রের স্বতঃস্ফূর্ত প্রেরণায় বঙ্কিমচন্দ্র কপালকুণ্ডলা চরিত্রটিকে অদৃষ্টতত্ত্বের অনুগামী করেছেন। দস্যু কর্তৃক পরিত্যক্ত অরণ্যময় জীবনে কাপালিকের সঙ্গে, নব কুমারের সঙ্গে পরিচয়, বিবাহ ও সংসার জীবনে তার জীবন চক্রের প্রতিটি স্তরে দৈব শক্তির প্রভাব অনিবার্য। তার জীবন ট্রাজেডির শেষ পর্ব ঈশ্বর নির্দেশিত পথে পরিসমাপ্ত হয়েছে। অপূর্ব নিলিপ্ততায় দেবীর আজ্ঞা পালনের জন্যই তার কৃতসংকল্পতা, পবিত্র, বিশুদ্ধ আত্মার দেবী বরণে আত্মবিসর্জন। প্রকৃতপক্ষে, বঙ্কিমের অপূর্ব সৃষ্টি কপালকুণ্ডলা চরিত্র, বাংলা সাহিত্যের ব্যতিক্রমী একটি চরিত্র।