লালসালু উপন্যাসের মজিদ চরিত্র বিশ্লেষণ – বাংলা উপন্যাসের প্রবাদ পুরুষ সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ (জন্ম : ১৯২২; মৃত্যু : ১৯৭০ তাঁর উপন্যাসে মানুষ ও সমাজকে মূল কেন্দ্রে উপস্থাপন করেছেন।পাঠক নন্দিত ও সমালোচক প্রশংসিত উপন্যাস ‘লালসালু’। ‘লালসালু’ তাঁর রচিত প্রথম উপন্যাস। ঐতিহাসিক বাস্তববাদের দৃষ্টিতে রচিত এ উপন্যাসে দুর্ভিক্ষ আক্রান্ত ভাগ্যান্বেষী একজন মানুষ কিভাবে জীবিকার সংগ্রামে ধর্মব্যবসায়ী হয়ে ওঠে এবং কুসংস্কারাচ্ছন্ন গ্রাম্য মানুষের মধ্যে আপন প্রতিপত্তি ধরে রাখে তারই চিত্র তুলে ধরা হয়েছে। এ উপন্যাসের ক্যানভাসে ধর্মের নামে শাসন ও শোষণ এবং ধর্মীয় ভন্ডামীর চিত্র স্পষ্ট আভাসিত হয়েছে।এ উপন্যাসের কেন্দ্রীয় চরিত্র মজিদ। তাকে কেন্দ্র করেই উপন্যাসের কাহিনী ও মূল প্রতিপাদ্য বিষয় বর্ণিত হয়েছে। মজিদ অস্তিত্ব রক্ষার সংগ্রামে শস্যহীন জনবহুল জন্মস্থান (যেখানে প্রতিবেশী শস্যের চেয়ে টুপি বেশি) ত্যাগ করে।

মজিদ জন্মস্থান ত্যাগ করে কেন
লালসালু উপন্যাসের মজিদ চরিত্র বিশ্লেষণ করতে গেলে দেখা যায়, মজিদ পাহাড়ি মানুষ। তার জন্ম গারো পাহাড়ে। সেখানে আবাদযোগ্য জমি থাকলে ও জনসংখ্যার তুলনায় তা নিতান্তই কম। তাছাড়া খরা, অতিবৃষ্টি ও অনাবৃষ্টিতে ফসল নষ্ট হয়। নদীর স্রোতের তোড়ে আবাদযোগ্য জমি বিলীন হয়। তাই নিরন্ন, ক্ষুধা, দারিদ্র থেকে মুক্তি পেতে জীবন ও জীবিকার জন্য এ অঞ্চলের মানুষ দেশত্যাগ করে। বিভিন্ন স্থানে ছড়িয়ে পড়ার আগে এখানকার লোকজন মূলধন হিসেবে অর্জন করে ধর্মীয় জ্ঞান। আর সেই ধর্মীয় জ্ঞান সম্বল করে অন্যদের দেখাদেখি মজিদও দেশ ত্যাগ করে।
মজিদের আগমন এবং পীরের কবর আবিষ্কার
মজিদ গারো পাহাড়ে কিছুকাল কাটিয়ে এক স্তব্ধ দুপুরে নাটকীয় কায়দায় হাজির হয় মহব্বত নগর গ্রামে। বেঁচে থাকার নিছক জৈব তাগিদেই ভগ্ন ও বিস্তৃত এক প্রাচীন কবরকে মোদাচ্ছের পীরের কবর বলে ঘোষণা দিয়ে গ্রামবাসীকে সচকিত ও লজ্জিত করে তোলে। তার জীবন থেকে মুছে ফেলতে চায় গারো পাহাড়ের সেই দুঃস্বপ্নের দৈন্যদগ্ধ্য দিনগুলো।লালসালুতে ঢাকা কবর ক্রমশ হয়ে ওঠে তার ক্ষমতা ও প্রতিষ্ঠার হাতিয়ার।
মজিদের টিকে থাকার লড়াই ও অস্তিত্ব
লালসালু উপন্যাসের মজিদ চরিত্র বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, মজিদ ছিল অত্যন্ত সুকৌশলী।মহব্বত নগর গ্রামে ধর্মান্ততার আবহ গড়ে তোলার ক্ষেত্রে প্রথম থেকেই মসজিদের প্রতিটি পদক্ষেপ ছিল সু-কৌশলী, সুচিন্তিত, ফলপ্রসূ ও সুদূরপ্রসারী। ফলে খুবই স্বল্প সময়ের মধ্যেই মসজিদের মনোবাসনা অনুযায়ী মিথ্যা ধর্মাচারের জালে বাধা পড়েছে মহব্বত নগরের নিরীহ মানুষগুলো।
অল্প সময়ের মধ্যেই তাই জঙ্গল সাফ হয়।ইট সুরকি ও সালুকাপড়ে পরিবর্তিত হয়ে জরাজীর্ণ অপরিচিত কবরটি হয়ে ওঠে মোদাচ্ছের পীরের মাজার। মাজারের চাকচিক্য ও সৌন্দর্য বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে মজিদের জীবনে লক্ষণীয় ও গুণগত পরিবর্তন আসে। তার জোত্-জমি হয়, ঘরবাড়ি ওঠে এভাবেই বিপন্নসত্তা মজিদ বিত্ত বৈভবের অধিকারী ,স্বচ্ছলতায় শিকড় গাড়া বৃক্ষ, মহব্বত নগরের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ ও নিয়ন্ত্রণকারী ব্যক্তি হয়ে ওঠে। গ্রামে তার প্রভাব অপ্রতিরোধ্য, প্রগাঢ় ও গ্রামের সংস্কার পুনর্গঠনে মজিদ অপরিহার্য।
ধর্মের অপব্যবহার
লালসালু উপন্যাসের মজিদ চরিত্র বিশ্লেষণ করলে বোঝা যায় এই চরিত্রটি মানুষের বেঁচে থাকার অস্তিত্বের সংকটকে তুলে ধরেছে।তাই এই সংকটে নিজের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার লড়াইয়ে তার অর্জিত ধর্মীয় জ্ঞানকে পুঁজি করে গ্রামের সহজ সরল ধর্মান্ধ মানুষদের হাতিয়ার করে ধর্মের অপব্যবহার করেছে।
অস্তিত্বের সংকটে ভীত মজিদ
মহব্বত নগর গ্রামে ন্যূনতম অধিকার প্রতিষ্ঠার পর থেকেই মজিদ নিজের উপভোগ্য চেতনাতে সবিশেষ গুরুত্ব দিয়েছেন।মজিদ বুঝেছে জীবনকে সে উপভোগ করেনি। জীবন উপভোগ না করতে পারলে কিসের মান-যশ-সম্পত্তি? আর এই পর্যায় থেকেই প্রকৃতঅর্থে সে অগ্রসর হয়েছে শঠতার পথে। কেননা, অন্যায়ভাবে প্রতারণার মাধ্যমে মজিদ যা করেছে তা হারানোর ভয়ই তাকে সর্বক্ষণ ছায়ার মতো তাড়িত করেছে।
মজিদের বিবাহ
মজিদের মধ্যে আত্মকেন্দ্রিক জগত জগত যেমন ঔপন্যাসিক ফুটিয়ে তুলেছেন, তেমনি তার অতৃপ্ত বুভুক্ষু যৌন আকাঙ্ক্ষাকে তুলে ধরেছেন উপন্যাসে।মজিদ দুটি বিয়ে করে। আসুন এবার এই একাধিক বিয়ে করার কারণ লালসালু উপন্যাসের মজিদ চরিত্র বিশ্লেষণ করি –
মজিদের প্রথম স্ত্রী
মজিদের প্রথম স্ত্রী রহিমা। রহিমা মজিদের যৌন কামনাকে পরিতৃপ্ত করতে পারেনি। কারণ, ঠান্ডা ও ভীতু স্বভাবের রহিমা মজিদকে দেখেছে সম্মান, শ্রদ্ধা ও ভয়ের চোখে। তার রক্তের নেশা জাগানো উত্তাপ ছিল না। রহিমার না আছে অভিমান, না আছে চপলতা, এমন মানুষ ভালো লাগে না মজিদের।
মজিদের এই অতৃপ্ত কামনা থেকেই খালেক ব্যাপারীর স্ত্রী আমেনা বিবির সুন্দর পা দেখে তার মধ্যে স্নেহ মমতা উঠে না এসে, আসে বিষাক্ত মনোভাব।
মজিদের দ্বিতীয় স্ত্রী
মজিদের দ্বিতীয় স্ত্রী জমিলা।মজিদ নিজের যৌনকামনা চরিতার্থ ও আপন মনের নেশা পবনের জন্য বিড়াল ছানার মত একরতি মেয়ে জমিলাকে ঘরে এনে নিজের ইচ্ছে মতো ব্যবহার করতে চায়।কিন্তু জমিলা ছিল রহিমার ঠিক বিপরীত চরিত্র। জমিলা কাউকে ভয় পেত না এমনকি মজিদ কে নয়।জমিলা বাংলা সাহিত্যের প্রথম বিদ্রোহী নারী চরিত্র।
মজিদের দ্বিতীয় বিয়ে করা ভুল ছিল কেন
নিঃসন্তান মজিদ নিঃসঙ্গ অনুভব করে। তার নিঃসঙ্গ জীবন থেকে মুক্তি এবং একজন নতুন সঙ্গী পেতে দ্বিতীয় বিয়ে করে। কিন্তু জমিলাকে বিয়ে করা মসজিদের জীবনে এক মারাত্মক ভুল ছিল। কারণ, দিন কয়েকের মধ্যে জমিলার আসল রূপ প্রকাশ পায়। মজিদ ধীরে ধীরে বুঝতে পারে খোদার ভয়, মানুষের ভয় তথা মজিদ ভীতি এবং মাজার ভীতি এই ত্রয়ী ভীতির কোনটাই জমিলার মধ্যে নাই। তাই জমিলাকে কাছে পেয়েও ক্ষুদ্র লতার মত মেয়েটির পর্বত ভয়টা দুর্দান্ত হয়ে ওঠে মজিদের।
মজিদের আত্মপ্রকাশ
লালসালু উপন্যাসের মজিদ চরিত্র বিশ্লেষণে দেখা যায় বিভিন্ন প্রতিকূল অবস্থায় মজিদ দু’ভাবে আত্মপ্রকাশ করেছে-
- প্রথম রূপে সে অভিজ্ঞ, প্রত্যুৎপন্নমতি সংযত ও সূক্ষ্ম কৌশলী। তাহের কাদেরের বাবা ও আমেনা বিবির প্রতি আচরণের মাধ্যমে তার এই প্রথম রূপের পরিচয় পাওয়া যায়।
- দ্বিতীয়রূপে সে রুদ্র, বিকৃত মস্তিষ্ক এমনকি শক্তি প্রয়োগেও দ্বিধাহীন।আওয়াল পুরের পীর ও জমিলাকে আশ্রয় করেই তার এই বিশেষ ব্যক্তি স্বরূপ প্রকাশ পেয়েছে।
আওয়ালপুরে আগত পীর মজিদের সমগোত্রীয়। কিন্তু তার প্রতিষ্ঠা মসজিদের মতো নয়। মজিদ শিকড় গাড়া, আর সে ভ্রাম্যমান। তাই তার আত্মপ্রতিষ্ঠা মজিদের সাথে অনিবার্য সংঘাত। ফলে মজিদ তার প্রতিবাদ করে এবং তাকে আউয়ালপুর থেকে উচ্ছেদ করে।
মজার ব্যাপার হলো, যখনই মজিদের অস্তিত্ব বিপন্ন, তার প্রতিষ্ঠা হুমকির সম্মুখীন হওয়ার সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে, তখনই মজিদ হয়ে উঠেছে নিষ্ঠুর, নির্মম ও প্রতিশোধ কামী। আর সেই প্রবাহ যাদের মাধ্যমে এসে মজিদকে স্পর্শ করেছে তাদের কাউকে মজির ক্ষমা করেনি।
❓ সাধারণ কিছু প্রশ্নোত্তর (FAQ)
প্রশ্ন: ‘লালসালু’ উপন্যাসের প্রধান চরিত্রের নাম কি?
উত্তর: ‘লালসালু’ উপন্যাসের প্রধান চরিত্রের নাম মজিদ ।
প্রশ্ন : সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ এর জন্ম ও মৃত্যু সাল কত ?
উত্তর : সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ এর জন্ম ১৯২২ সালে এবং মৃত্যু ১৯৭০ সালে।
প্রশ্ন : সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ রচিত প্রথম উপন্যাস কোনটি ?
উত্তর : সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ রচিত প্রথম উপন্যাস ‘লালসালু’।
প্রশ্ন : মজিদের গ্রামের নাম কি?
উত্তর : মজিদের গ্রামের নাম মহব্বত নগর।
প্রশ্ন : মজিদের পাশের গ্রামে নাম কি?
উত্তর : মজিদের পাশের গ্রামে নাম আওয়ালপুর।
প্রশ্ন : মজিদ মহব্বত নগর গ্রামে আসার পূর্বে কোথায় থাকতো ?
উত্তর : মজিদ মহব্বত নগর গ্রামে আসার পূর্বে ছিল গারো পাহাড়ে।
প্রশ্ন : মজিদ কোন পীরের কবর আবিষ্কার করে?
উত্তর : মজিদ মোদাচ্ছের পীরের কবর আবিষ্কার করে।
প্রশ্ন : মজিদের শক্তির উৎস কি?
উত্তর : মাজারটি হলো মজিদের শক্তির উৎস।
প্রশ্ন : মজিদ বিয়ে করেছে কয়টি?
উত্তর : মজিদ ২টি বিয়ে করেছে?
প্রশ্ন : মজিদের প্রথম স্ত্রীর নাম কি?
উত্তর : মজিদের প্রথম স্ত্রীর নাম রহিমা।
প্রশ্ন : মজিদের দ্বিতীয় স্ত্রীর নাম কি ?
উত্তর : মজিদের দ্বিতীয় স্ত্রীর নাম জমিলা।
উপসংহার
পরিশেষে বলা যায়, লালসালু উপন্যাসের মজিদ চরিত্রটির মধ্য দিয়ে সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ অস্তিত্ববাদী জীবন দর্শনের প্রয়োগ দেখিয়েছেন। লালসালু উপন্যাস সম্পর্কে বিভিন্ন ধরনের মন্তব্য থাকলেও লেখক কোন খন্ডিত দৃষ্টি নিয়ে উপন্যাস রচনা করেননি। মজিদও কোন খন্ডিত দৃষ্টিভঙ্গির চরিত্র নয়। মজিদকে অখন্ড সমগ্র ও পূর্ণাঙ্গ রূপে নির্মাণই ঔপন্যাসিকের মৌল ও অভিপ্রায়। তাই লালসালুতে মজিদ কোন বিচ্ছিন্ন একক সত্তা নয়। বিশেষ অর্থে সামাজিক পরিবেশের সমগ্র মানুষের প্রতিনিধি মজিদ।